শরৎকালে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই উৎসবে যে দেবীমূর্তি পূজিত হন তিনি অসুর দলনী দশপ্রহরণধারিনী দুর্গা। সঙ্গে তার পুর্ত-কন্যারাও থাকে। কার্তিক, গণেশ লক্ষ্মী ও সরস্বতী।
এই মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা বাঙালির কাছে সকল দুর্গতি নাশিনী বলে আরাধিত। তিনি বাঙালির সমস্ত দুঃখ দুর্দশা দূর করবেন বলে মনে করা হয়। তাই তাঁর আরাধনায় এতো ধুম।
কিন্তু সত্যিই কে সেই প্রতিমার মধ্যে দুর্গা থাকেন? আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে বলা যায় থাকেন। কারণ পূজার সময় তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তিনি কি সত্যিই সকলের দুঃখ-কষ্ট ঘুচিয়ে দিতে পারেন? এক্ষেত্রে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও বলা যায় দেবী দূর্গার সকলের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচানো সম্ভব নয়। তাতে যার যতোই দেবীর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা থাকুক না কেন?
কিন্তু আমরা যদি প্রতিমাতে নয়, প্রত্যেকে নিজের নিজের মায়ের মধ্যে দুর্গাকে খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে হতাশ হতে হবে না। মায়েরা সর্বংসহা। হাজার বাধা- বিপত্তি দুঃখ আসুক মা-দের সন্তানের প্রতি ভালবাসা এতটুকু হেরফের হয় না। সন্তানকে সব সময় বুকে করে আগলে রাখেন। শত দুঃখ-কষ্ট আসুক, সন্তানকে তা থেকে দূরে রাখেন। এর জন্য যদি তাকে প্রাণ দিতে হয় তবে হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিতে পিছপা হন না। তবু দুঃখের এতটুকু আঁচ তাদের সন্তানদের লাগতে দেন না। মায়েরাই সন্তানের জন্ম দেন। এরজন্য মা-দের গর্ভযন্ত্রনাও প্রসব বেদনা সহ্য করতে হয়। সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা সে কষ্ট ভুলে যান। এটা শুধু মা-দের দ্বারাই সম্ভব। মা-দের এরপর অসহায় মানব শিশুকে ধীরে ধীরে বড়ো করে তোলার পেছনে কত শ্রম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস থাকে। তা মানুষ মাত্রেরই অজানা নয়। বড়হবার পরও মা-রা সন্তানদের চোখের আড়াল করতে পারেন না।
এহেন মায়েরা দুর্গা নয় তো কি? তাই দুর্গাকে প্রতিমাতে খোঁজার চেয়ে মায়েদের মধ্যে খোঁজা অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। দেবী দুর্গা প্রতিমাতে কতটা থাকেন জানি না। তবে মায়েদের মধ্যে যে তাকে পাওয়া যায় এব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – “মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।” সত্যিই ‘মা’ বলতে যার কথা… তার তুলনা হয় না।
বঙ্কিম বলেছেন – “বন্দে মাতরম্…. তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে” একথা খুবই সত্যি আমরা নিজের মাকে অবহেলা করে, প্রতিমার মধ্যে খুঁজে ফিরি। দেবী দুর্গা সকলের মা। আপামর বাঙালি তাকেই মাতৃ সম্বোধন করে সমস্ত দুঃখ- দুর্দশা মোচনের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। শরৎকাল এলে প্রকৃতি শিউলি। কাশফুলে সেজে ওঠে। তখনই মায়ের আগমনী সঙ্গীত বেজে ওঠে। সবাই মায়ের রাতুল চরণে আঞ্জলি দিয়ে, নিজেকে কৃতার্থ মনে করে। এই মা সকলের মা। দেবতারা যখন অসুরদেব পীড়নে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। তখনই তিনি আধিভূতা হয়েছিলেন, তাদের রক্ষার জন্য।
এমন একজন দেবী, যিনি কঠিন কঠোর মূর্তিতে দশপ্রহরণধারিনী রূপে শরৎকালে বাঙালিদের দ্বারা পূজিত হন ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে আমরা ঘরের মেয়েকেই খুঁজে ফিরি। যিনি বৃদ্ধ স্বামীর গৃহে পুত্র-কন্যা নিয়ে অশেষ দুঃখের মধ্যে জীবনযাপন করেন। বছরের তিনটি দিনের জন্য বাপের বাড়ী আসার আগ্রহে দিন গোনেন। সেই গৌরীদান প্রথার বলি কন্যা সন্তানদের বাপের বাড়ী আসার আনন্দ দূর্গাপূজায় অনুভব করি। কন্যাদের আমরা মা-বলেই সম্বোধন করি। গর্ভধারিনী মা হোক বা কন্যা সন্তান যা হোক, তাদের অবলা, দুর্বল বলে মনে করা হলেও, আসলে তারা মোটেই দুর্বল নন, তাদের মধ্যেই আমাদের শক্তি নিহিত। শিব শক্তিবিনা শব মাত্র। নারীই তাকে শক্তি যোগায়। তাই প্রতিমাতে আমরা বৃথাই থাকে অর্থাৎ দুর্গাকে খুঁজে বেড়াই। নারীজাতি অর্থাৎ মাতৃজাতির মধ্যে তিনি রয়েছেন। নারী যখন আত্মচেতনা লাভ করবে। ‘আত্মা নাং বিধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানবে। তখনই যথার্থ মাতৃশক্তির উদ্বোধন ঘটবে। শাস্ত্রে বলেছেন “কুপুত্র যদিবা হয়, কুমাতা কখনো নয়”। কুপুত্রের উদাহরণ তো এখন সর্বত্র পরিদৃষ্ট, নিজেদের সুখ সুবিধার জন্য পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো তার ঝুলন্ত উদাহরণ। তাদের নারী জাতির উপর অত্যাচার, লাঞ্ছনার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। তবু মায়েরা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। শাসন ব্যবস্থায় নারী জনসমাজের অর্ধাংশ হওয়া সত্ত্বেও এক তৃতীয়াংশ অধিকার লাভের জন্য এখন তাদের মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও আশাকরি এমন একটি দিন আসবে, যেদিন নারী তার অধিকার নিজেই বুঝে নেবে। সেদিন প্রতিমাতে নয়, সমস্ত নারীজাতির মধ্যে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।